মির্জা আজমকে খুশি করতে পৌরসভার চার কোটি টাকা ব্যয়,,
গাজী মাজহারুল ইসলাম জামালপুর
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জামালপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা আজমকে খুশি করতে একটি বেসরকারি ক্লাবের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে জামালপুর পৌরসভা ও জেলা পরিষদ। অথচ অভিযোগ আছে সেই ক্লাবটিতে চলতো অনৈতিক কাজ।
জামালপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ছানোয়ার হোসেন ছানু তার রাজনৈতিক গুরু মির্জা আজমকে খুশি করতে একটি বেসরকারি ক্লাবকে ইজারা দেন পৌরসভার ডাম্পিং স্টেশনের জমি। মেয়র ছানু ছিলেন মির্জা আজমের জামালপুরের সব ‘ভালো-মন্দ’ কাজের প্রধান সিপাহী। পৌরসভা প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা খরচ করে সেই ক্লাবটির জন্য। এছাড়া জেলা পরিষদের ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ক্লাবটির প্রধান গেট নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।
জামালপুর পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে জেলা প্রশাসক শহরের পলাশগড় মৌজার ১ একর ৪৬ শতাংশ জমি পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করেন। ১৯৯৫ সালে একটি ডাম্পিং স্টেশন গড়ে তোলা হয় সেই জমিতে। ২০০৯ সালে জেলা প্রশাসক আবারো পলাশগড় মৌজায় ২ একর ৮৫ শতাংশ ও সিংহজানী মৌজায় সাড়ে ৩১ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করে তৎকালীন মেয়র শাহ মো. ওয়ারেছ আলী মামুনের কাছে হস্তান্তর করেন। এতে পৌরসভার জমি গিয়ে দাঁড়ায় ৪ একর সাড়ে ৬২ শতাংশে। পরে সেই জমির ওপর ডাম্পিং স্টেশনের জন্য শেড তৈরি করা হয়।
মির্জা আজমের চাচা মেয়র মির্জা সাখাওয়াতুল আলম মনির মাধ্যমে ২০২০ সালে পৌরসভার মালিকাধীন অধিগ্রহণ করা জমিতে পৌরসভার উদ্যোগে সর্বসাধারণের সুস্থ চিত্তবিনোদন, খেলাধুলা ও ব্যায়ামের জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে আধুনিক বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন নেন। এরপরই মেয়র নির্বাচিত হন ছানু। ওই বছরই সেই জমি ইজারা দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করে পৌর কর্তৃপক্ষ। সেই ইজারায় অংশগ্রহণ করে সাবেক মেয়র মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন ছানুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মাসুম অ্যান্ড ব্রাদার্স, আয়ান এন্টারপ্রাইজ ও জামালপুর রিক্রেয়েশন ক্লাব। এখানে রিক্রেয়েশন ক্লাব সর্বোচ্চ দরদাতা হয় এবং ওই ক্লাবকে ৩ একর সাড়ে ১৬ শতাংশ জমি ২০ বছরের জন্য ইজারা দেয় পৌর কর্তৃপক্ষ।
এরপর ২০২১ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয় পুরো ডাম্পিং স্টেশন। পরে শহরের ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০২২ সালে দশ একর জমিতে ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে শহরের কম্পপুর এলাকায় স্যানেটারি ল্যান্ডফিল নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। এছাড়াও পৌরসভার আট শহর প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে ক্লাবটির জন্য নির্মাণ করা হয় সীমানা প্রাচীর, রাস্তা ও ড্রেন। তবে এখনো সমাপ্ত হয়নি রাস্তার কাজ। এছাড়াও ৮৮ লাখ ব্যায়ে ক্লাবটির প্রধান গেইট নির্মাণ করে দিচ্ছে জেলা পরিষদ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মির্জা আজমের নির্দেশে ক্লাবটিতে চলতো অনৈতিক কাজ। তবে ক্লাব নির্মাণের ফলে বন্ধ হয়ে যায় কয়েক গ্রামের হাজারো মানুষের চলাচলের রাস্তা। এছাড়াও দখল করা হয়েছে কয়েকজনের জমি। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন অনেকে।
মাসুদ নামে স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, এখানে ভালো কোনো কাজই হতো না। এখানে এরা ক্লাব দিয়ে হাজার হাজার টাকা দামের মদ, জুয়া, আড্ডাস্থল বানিয়েছিল।
স্থানীয় ব্যক্তি আনোয়ার বলেন, এখানে ক্লাব দিলো, আমরা মনে করলাম পোলাপান খেলাধুলা করবে। কিন্তু দেখা যায় যে এখানে মদ চলে, জুয়া চলে, লাখ লাখ টাকার ব্যবসা চলে।
পলাশগড় এলাকার বাসিন্দা মো. হারুন অর রশিদ বলেন, হঠাৎ করে রাস্তা বন্ধ করে দেয় ছানু। আমি এর প্রতিবাদ করেছিলাম। প্রতিবাদ করাতে মেয়র ছানু আমাকে মারধর করে। তার জন্য আমি দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলাম। আমি ইন্ডিয়া গিয়েও চিকিৎসা করে এসেছি। এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে সুস্থ না আমি।
রিক্রিয়েশন ক্লাবের সদস্য হওয়ার জন্য গুনতে হতো ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। এসব সদস্যের সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করা প্রয়োজন বলে দাবি করছেন অনেকে। আর একটি বেসরকারি ক্লাবের জন্য পৌরসভার এতো ব্যয় অযৌক্তিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করছে ক্লাব সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে পৌর প্রশাসন।
জামালপুর রিক্রিয়েশন ক্লাবের নবগঠিত পরিচালনা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক জাকির হোসেন খান বলেন, স্থানীয়রা যে অভিযোগ করেছে, সেটার ভিত্তি আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। প্রশাসনের কাছে আমরাও গিয়েছিলাম। প্রশাসনকে বলেছি। তাদের যদি কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থেকে থাকে, তারা যদি দেখাতে পারে যে আমরা রাস্তা বন্ধ করেছি, জমি দখল করেছি, আমরা অবশ্যই সেটার প্রতিকার করবো, ব্যবস্থা নেবো।
জামালপুর দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, ৫-৬ লাখ টাকা করে সদস্য হওয়া সদস্যদের সম্পদের হিসাবটা দেখা দরকার। সবাই যে অবৈধ কালো টাকার মালিক তা না। আমি অনতিবিলম্বে সদস্যদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার জন্য দুদক ও প্রশাসনকে আহ্বান জানাচ্ছি।
জামালপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ওয়ারেছ আলী মামুন বলেন, স্বার্থসংশ্লিষ্টতার বাইরে পৌরসভা এই ধরনের জায়গা, যেটা পৌরসভার ল্যান্ড রেলস্টেশন হিসেবে ব্যবহার হতো, সেটা একটা ক্লাবের নামে দেওয়া কখনোই যৌক্তিক না। পৌরসভা এই অধিকার রাখে বলে আমার কাছে মনে হয় না।
জামালপুর পৌরসভার পৌর প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ পরিচালক মৌসুমী খানম বলেন, আমি পৌরসভার প্রশাসক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি। আমরা নাগরিক সেবাকে প্রাধান্য দিচ্ছি। আমি রিক্রিয়েশন ক্লাব সম্পর্কে জানি না, আমাকে রিক্রিয়েশন ক্লাব সম্পর্কে জনতে
সুস্থ বিনোদন, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য গড়ে তোলা রিক্রিয়শন ক্লাবের সদস্য সংখ্যা ৪৬৯ জন। আর ক্লাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। গত ৫ আগস্ট অস্থায়ী ভবন ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এখন ক্লাবটি বন্ধ রয়েছে।